
Saturday, March 30, 2013
Wednesday, March 27, 2013
ODBHUT ADAR
অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ পৃথিবীতে আজ
জীবনানন্দ দাস
অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ পৃথিবীতে আজ,
যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশী আজ চোখে দেখে তারা;
যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই, প্রীতি নেই, করুণার আলোড়ন নেই
পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।
যাদের গভীর আস্থা আছে আজও মানুষের প্রতি,
এখনও যাদের কাছে স্বাভাবিক বলে মনে হয়
মহৎ সত্য বা রীতি, কিংবা শিল্প অথবা সাধনা
শকুন ও শেয়ালের খাদ্য আজ তাহাদের হৃদয়।
যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশী আজ চোখে দেখে তারা;
যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই, প্রীতি নেই, করুণার আলোড়ন নেই
পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।
যাদের গভীর আস্থা আছে আজও মানুষের প্রতি,
এখনও যাদের কাছে স্বাভাবিক বলে মনে হয়
মহৎ সত্য বা রীতি, কিংবা শিল্প অথবা সাধনা
শকুন ও শেয়ালের খাদ্য আজ তাহাদের হৃদয়।
PRIOTOMASU
প্রিয়তমাসু
অনেক রক্তাক্ত পথ অতিক্রম ক'রে
আজ এখানে এসে থমকে দাড়িয়েছি-
স্বদেশের সীমানায়।
দূসর তিউনিসিয়া থেকে স্নিগ্ধ ইতালী,
স্নিগ্ধ ইতালী থেকে ছুটে গেছি বিপ্লবী ফ্রান্সে
নক্ষত্রনিয়ন্ত্রিত নিয়তির মতো
দুর্নিবার, অপরাহত রাইফেল হাতে;
- ফ্রান্স থেকে প্রতিবেশী বার্মাতেও।
আজ দেহে আমার সৈনিকের কড়া পোশাক,
হাতে এখনো দুর্জয় রাইফেল,
রক্তে রক্তে তরঙ্গিত জয়ের আর শক্তির দুর্বহ দম্ভ,
আজ এখন সীমান্তের প্রহরী আমি।
আজ নীল আকাশ আমাকে পাঠিয়েছে নিমন্ত্রণ,
স্বদেশের হাওয়া বয়ে এনেছে অনুরোধ,
চোখের সামনে খুলে ধরেছে সবুজ চিঠিঃ
কিছুতেই বুঝি না কী ক'রে এড়াব তাকে?
কী ক'রে এড়াব এই সৈনিকের কড়া পোশাক?
যুদ্ধ শেষ। মাঠে মাঠে প্রসারিত শান্তি,
চোখে এসে লাগছে তারই শীতল হাওয়া,
প্রতি মুহূর্তে শ্লথ হয়ে আসে হাতের রাইফেল,
গা থেকে খসে পড়তে চায় এই কড়া পোশাক,
রাত্রে চাঁদ ওঠেঃ আমার চোখে ঘুম নেই।
তোমাকে ভেবেছি কতদিন,
কত শত্রুর পদক্ষেপ শোনার প্রতীক্ষার অবসরে,
কত গোলা ফাটার মুহূর্তে।
কতবার অবাধ্য হয়েছে মন, যুদ্ধজয়ের ফাঁকে ফাঁকে
কতবার হৃদয় জ্বলেছে অনুশোচনার অঙ্গারে
তোমার আর তোমাদের ভাবনায়।
তোমাকে ফেলে এসেছি দারিদ্র্যের মধ্যে
ছুঁড়ে দিয়েছি দুর্ভিক্ষের আগুনে,
ঝড়ে আর বন্যায়, মারী আর মড়কের দুঃসহ আঘাতে
বাব বার বিপন্ন হয়েছে তোমাদের অস্তিত্ব।
আর আমি ছুটে গেছি এক যুদ্ধক্ষেত্র থেকে আর এক যুদ্ধক্ষেত্র।
জানি না আজো, আছ কি নেই,
দুর্ভিক্ষে ফাঁকা আর বন্যায় তলিয়ে গেছে কিনা ভিটে
জানি না তাও।
তবু লিখছি তোমাকে আজঃ লিখছি আত্মম্ভর আশায়
ঘরে ফেরার সময় এসে গেছে।
জানি, আমার জন্যে কেউ প্রতীক্ষা ক'রে নেই
মালায় আর পতাকায়, প্রদীপে আর মঙ্গলঘটে;
জানি, সম্বর্ধনা রটবে না লোক মুখে,
মিলিত খুসিতে মিলবে না বীরত্বের পুরস্কার।
তবু, একটি হৃদয় নেচে উঠবে আমার আবির্ভাবে
সে তোমার হৃদয়।
যুদ্ধ চাই না আর, যুদ্ধ তো থেমে গেছে;
পদার্পণ করতে চায় না মন ইন্দোনেশিয়ায়
আর সামনে নয়,
এবার পেছনে ফেরার পালা।
পরের জন্যে যুদ্ধ করেছি অনেক,
এবার যুদ্ধ তোমার আর আমার জন্যে।
প্রশ্ন করো যদি এত যুদ্ধ ক'রে পেলাম কী? উত্তর তার-
তিউনিসিয়ায় পেয়েছি জয়,
ইতালীতে জনগণের বন্ধুত্ব,
ফ্রান্সে পেয়েছি মুক্তির মন্ত্র;
আর নিষ্কণ্টক বার্মায় পেলাম ঘরে ফেরার তাগাদা।
আমি যেন সেই বাতিওয়ালা,
সে সন্ধ্যায় রাজপথে-পথে বাতি জ্বালিয়ে ফেরে
অথচ নিজের ঘরে নেই যার বাতি জ্বালার সামর্থ্য,
নিজের ঘরেই জমে থাকে দুঃসহ অন্ধকার।।
(কাব্যগ্রন্থঃ ঘুমনেই)
JONOTAR MUKHE
জনতার মুখে ফোটে বিদ্যুৎবাণী
জনতার মুখে ফোটে বিদ্যুৎবাণী;
আকাশে মেঘের তাড়াহুড়ো দিকে দিকে
বজ্রের কানাকানি।
সহসা ঘুমের তল্লাট ছেড়ে
শান্তি পালাল আজ।
দিন ও রাত্রি হল অস্থির
কাজ, আর শুধু কাজ!
জনসিংহের ক্ষুদ্ধ নখর
হয়েছে তীক্ষ্ণ, হয়েছে প্রখর
ওঠে তার গর্জন-
প্রতিশোধ, প্রতিশোধ!
হাজার হাজার শহীদ ও বীর
স্বপ্নে নিবিড় স্মরণে গভীর
ভুলি নি তাদের আত্মবিসর্জন।
ঠোঁটে ঠোঁটে কাঁপে প্রতিজ্ঞা দুর্বোধঃ
কানে বাজে শুধু শিকলের ঝন্ঝন্;
প্রশ্ন নয়কো পারা না পারার,
অত্যাচারীর রুদ্ধ কারার
দ্বার ভাঙা আজ পণ;
এতদিন ধ'রে শুনেছি কেবল শিকলের ঝন্ঝন্।
ওরা বীর, ওরা আকাশে জাগাত ঝড়,
ওদের কাহিনী বিদেশীর খুনে
গুলি, বন্দুক, বোমার আগুনে
আজো রোমাঞ্চকর;
ওদের স্মৃতিরা শিরায় শিরায়
কে আছে আজকে ওদের ফিরায়
কে ভাবে ওদের পর?
ওরা বীর, আকাশে জাগাত ঝড়!
নিদ্রায়, কাজকর্মের ফাঁকে
ওরা দিনরাত আমাদের ডাকে
ওদের ফিরাব কবে?
কবে আমাদের বাহুর প্রতাপে
কোটি মানুষের দুর্বার চাপে
শৃঙ্খল গত হবে?
কবে আমাদের প্রাণকোলাহলে
কোটি জনতার জোয়ারের জলে
ভেসে যাবে কারাগার।
কবে হবে ওরা দুঃখসাগর পার?
মহাজন ওরা, আমরা ওদের চিনি;
ওরা আমাদের রক্ত দিয়েছে,
বদলে দুহাতে শিকল নিয়েছে
গোপনে করেছে ঋণী।
মহাজন ওরা, আমরা ওদের চিনি!
হে খাতক নির্বোধ,
রক্ত দিয়েই সব ঋণ করো শোধ!
শোনো, পৃথিবীর মানুষেরা শোনো,
শোনো স্বদেশের ভাই,
রক্তের বিনিময় হয় হোক
আমরা ওদের চাই।।
(কাব্যগ্রন্থঃ ঘুমনেই)
RIDOYE PREMER DIN
হৃদয়ে প্রেমের দিন
জীবনানন্দ দাস
হৃদয়ে প্রেমের দিন কখন যে শেষ হয় — চিতা শুধু পড়ে থাকে
তার,
আমরা জানি না তাহা; — মনে হয় জীবনে যা
আছে আজো তাই শালিধান
রূপশালি ধান তাহা… রূপ, প্রেম… এই ভাবি… খোসার মতন নষ্ট
ম্লান
একদিন তাহাদের অসারতা ধরা পড়ে, — যখন সবুজ অন্ধকার,
নরম রাত্রির দেশ নদীর জলের গন্ধ কোন এক
নবীনাগতার
মুখখানা নিয়ে আসে — মনে হয় কোনোদিন
পৃথিবীতে প্রেমের আহ্বান
এমন গভীর করে পেয়েছি কি? প্রেম যে নক্ষত্র আর
নক্ষত্রের গান,
প্রাণ যে ব্যাকুল রাত্রি প্রান্তরের
গাঢ় নীল অমাবস্যায় –
চলে যায় আকাশের সেই দূর নক্ষত্রের লাল
নীল শিখার সন্ধানে,
প্রাণ যে আঁধার রাত্রি আমার এ, — আর তুমি স্বাতীর মতন
রূপের বিচিত্র বাতি নিয়ে এলে, — তাই প্রেম ধুলায়
কাঁটায় যেইখানে
মৃত হয়ে পড়ে ছিল পৃথিবীর শূণ্য পথে সে
গভীর শিহরণ,
তুমি সখী, ডুবে যাবে মুহূর্তেই রোমহর্ষে — অনিবার অরুণের
ম্লানে
জানি আমি; প্রেম যে তবুও প্রেম; স্বপ্ন নিয়ে বেঁচে
রবে, বাঁচিতে
সে জানে।
SE
সে
জীবনানন্দ দাস
আমাকে সে নিয়েছিলো ডেকে;
বলেছিলোঃ 'এ নদীর জল
তোমার চোখের মত ম্লান বেতফল;
সব ক্লান্তি রক্তের থেকে
স্নিগ্ধ রাখছে পটভূমি;
এই নদী তুমি।'
'এর নাম ধানসিঁড়ি বুঝি?'
মাছরাঙাদের বললাম;
গভীর মেয়েটি এসে দিয়েছিলো নাম।
আজো আমি মেয়েটিকে খুঁজি;
জলের অপার সিঁড়ি বেয়ে
কোথায় যে চলে গেছে মেয়ে।
সময়ের অবিরল শাদা আর কালো
বনানীর বুক থেকে এসে
মাছ আর মন আর মাছরাঙাদের ভালোবেসে
ঢের আগে নারী এক - তবু চোখ ঝলসানো আলো
ভালোবেসে ষোলো আনা নাগরিক যদি
না হয়ে বরং হতো ধানসিঁড়ি নদী।
ASE AMAR RIDOY ASE VORE
আছে আমার হৃদয় আছে ভরে
এখন তুমি যা খুশি তাই করো।
এমনি যদি বিরাজ' অন্তরে
বাহির হতে সকলই মোর হরো।
সব পিপাসার যেথায় অবসান
সেথায় যদি পূর্ণ করো প্রাণ,
তাহার পরে মরুপথের মাঝে
উঠে রৌদ্র উঠুক খরতর।
এই যে খেলা খেলছ কত ছলে
এই খেলা তো আমি ভালবাসি।
এক দিকেতে ভাসাও আঁখিজলে,
আরেক দিকে জাগিয়ে তোল' হাসি।
যখন ভাবি সব খোয়ালাম বুঝি
গভীর করে পাই তাহারে খুঁজি,
কোলের থেকে যখন ফেল' দূরে
বুকের মাঝে আবার তুলে ধর'।
রেলপথ। ই.আই.আর.
২১ আষাঢ় ১৩১৭
কাব্যগ্রন্থঃ গীতাঞ্জলি
রচনা সংখ্যাঃ ১১০
AJI BOSONTO JAGROTO DARE
আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে
তব অবগুন্ঠিত কুন্ঠিত জীবনে
কোরো না বিড়ম্বিত তারে।
আজি খুলিয়ো হৃদয়দল খুলিয়ো,
আজি ভুলিয়ো আপনপর ভুলিয়ো,
এই সংগীতমুখরিত গগনে
তব গন্ধ করঙ্গিয়া তুলিয়ো।
এই বাহিরভূবনে দিশা হারায়ে
দিয়ো ছড়ায়ে মাধুরী ভারে ভারে।
অতি নিবিড় বেদনা বনমাঝে রে
আজি পল্লবে পল্লবে বাজে রে -
দূরে গগনে কাহার পথ চাহিয়া
আজি ব্যকুল বসুন্ধরা সাজে রে।
মোর পরানে দখিন বায়ু লাগিছে,
কারে দ্বারে দ্বারে কর হানি মাগিছে,
এই সৌরভবিহবল রজনী
কার চরণে ধরণীতলে জাগিছে।
ওগো সুন্দর, বল্লভ, কান্ত,
তব গম্ভীর আহবান কারে।
বোলপুর
২৬ চৈত্র ১৩১৬
কাব্যগ্রন্থঃ গীতাঞ্জলি
রচনা সংখ্যাঃ ৫৫
AMI BOHU BASONAY PRANPONE CHAI
আমি বহু বাসনায় প্রাণপণে চাই
আমি বহু বাসনায় প্রাণপণে চাই,
বঞ্চিত করে বাঁচালে মোরে।
এ কৃপা কঠোর সঞ্চিত মোর
জীবন ভ'রে।
না চাহিতে মোরে যা করেছ দান
আকাশ আলোক তনু মন প্রাণ,
দিনে দিনে তুমি নিতেছ আমায়
সে মহাদানেরই যোগ্য করে
অতি-ইচ্ছার সংকট হতে
বাঁচায়ে মোরে।
আমি কখনো বা ভুলি, কখনো বা চলি
তোমার পথের লক্ষ্য ধরে-
তুমি নিষ্ঠুর সম্মুখ হতে
যাও যে সরে।
এ যে তব দয়া জানি হায়,
নিতে চাও ব'লে ফিরাও আমায়,
পূর্ণ করিয়া লবে এ জীবন
তব মিলনেরই যোগ্য করে
আধা- ইচ্ছার সংকট হতে
বাঁচায়ে মোরে।
বঞ্চিত করে বাঁচালে মোরে।
এ কৃপা কঠোর সঞ্চিত মোর
জীবন ভ'রে।
না চাহিতে মোরে যা করেছ দান
আকাশ আলোক তনু মন প্রাণ,
দিনে দিনে তুমি নিতেছ আমায়
সে মহাদানেরই যোগ্য করে
অতি-ইচ্ছার সংকট হতে
বাঁচায়ে মোরে।
আমি কখনো বা ভুলি, কখনো বা চলি
তোমার পথের লক্ষ্য ধরে-
তুমি নিষ্ঠুর সম্মুখ হতে
যাও যে সরে।
এ যে তব দয়া জানি হায়,
নিতে চাও ব'লে ফিরাও আমায়,
পূর্ণ করিয়া লবে এ জীবন
তব মিলনেরই যোগ্য করে
আধা- ইচ্ছার সংকট হতে
বাঁচায়ে মোরে।
JEDIN PHOTLO KOMOL
যেদিন ফুটল কমল কিছুই জানি নাই
যেদিন
ফুটল কমল কিছুই জানি নাই
আমি ছিলেম অন্যমনে |
আমার
সাজিয়ে সাজি তারে আনি নাই
সে যে রইল সঙ্গোপনে |
মাঝে মাঝে হিয়া আকুলপ্রায়
স্বপন দেখে চম্ কে উঠে চায়,
মন্দ মধুর গন্ধ আসে হায়
কোথায় দখিন সমীরণে |
ওগো
সেই সুগন্ধে ফিরায় উদাসিয়া
আমায় দেশে দেশান্তে |
যেন
সন্ধানে তার উঠে নিঃশ্বাসিয়া
ভুবন নবীন বসন্তে |
কে জানিত দূরে ত নেই সে
আমারি গো আমারি সেই যে,
এ মাধুরী ফুটেছে হায়রে
আমার
হৃদয় উপবনে |
শিলাইদহ ২৬ চৈত্র ১৩১৮
গীতিমাল্য - ১৭, গীতাঞ্জলি
গীতিমাল্য - ১৭, গীতাঞ্জলি
ONONTO PREM
অনন্ত প্রেম
জনমে জনমে যুগে যুগে অনিবার।
চিরকাল ধরে মুগ্ধ হৃদয় গাঁথিয়াছে গীতহার–
কত রূপ ধরে পরেছ গলায়, নিয়েছ সে উপহার
জনমে জনমে যুগে যুগে অনিবার।
যত শুনি সেই অতীত কাহিনী, প্রাচীন প্রেমের ব্যথা,
অতি পুরাতন বিরহমিলন কথা,
অসীম অতীতে চাহিতে চাহিতে দেখা দেয় অবশেষে
কালের তিমিররজনী ভেদিয়া তোমারি মুরতি এসে
চিরস্মৃতিময়ী ধ্র“বতারকার বেশে।
আমরা দুজনে ভাসিয়া এসেছি যুগলপ্রেমের স্রোতে
অনাদি কালের হৃদয়-উৎস হতে।
আমরা দুজনে করিয়াছি খেলা কোটি প্রেমিকের মাঝে
বিরহবিধুর নয়নসলিলে, মিলনমধুর লাজে–
পুরাতন প্রেম নিত্যনূতন সাজে।
আজি সেই চির-দিবসের প্রেম অবসান লভিয়াছে,
রাশি রাশি হয়ে তোমার পায়ের কাছে।
নিখিলের সুখ, নিখিলের দুখ, নিখিল প্রাণের প্রীতি,
একটি প্রেমের মাঝারে মিশেছে সকল প্রেমের স্মৃতি–
সকল কালের সকল কবির গীতি।
DEBOTAR GRASH
দেবতার গ্রাস
মৈত্র মহাশয় যাবে সাগরসংগমে
তীর্থস্নান লাগি। সঙ্গীদল গেল জুটি
কত বালবৃদ্ধ নরনারী, নৌকাদুটি
প্রস্তুত হইল ঘাটে।
পুণ্যলোভাতুর
মোক্ষদা কহিল আসি, 'হে দাদাঠাকুর,
আমি তব হব সাথি।' বিধবা যুবতী,
দুখানি করুণ আঁখি মানে না যুকতি,
কেবল মিনতি করে - অনুরোধ তার
এড়ানো কঠিন বড়ো। 'স্থান কোথা আর'
মৈত্র কহিলেন তারে। 'পায়ে ধরি তব'
বিধবা কহিল কাঁদি, 'স্থান করি লব
কোনমতে এক ধারে।' ভিজে গেল মন;
তবু দ্বিধাভরে তারে শুধালো ব্রাক্ষ্মণ,
'নাবালক ছেলেটির কী করিবে তবে?'
উত্তর করিল নারী, 'রাখাল? সে রবে
আপন মাসির কাছে। তার জন্ম-পরে
বহুদিন ভুগেছিনু সূতিকার জ্বরে,
বাঁচিব ছিল না আশা; অন্নদা তখন
আপন শিশুর সাথে দিয়ে তারে স্তন
মানুষ করেছে যত্নে - সে হতে ছেলে
মাসির আদরে আছে মার কোল ফেলে।
দুরন্ত মানে না কারে, করিলে শাসন
মাসি আসি অশ্রুজলে ভরিয়া নয়ন
কোলে তারে টেনে লয়। সে থাকিবে সুখে
মার চেয়ে আপনার মাসিমার বুকে।'
সম্মত হইল বিপ্র। মোক্ষদা সত্বর
প্রস্তুত হইল বাঁধি জিনিস-পত্তর,
প্রাণমিয়া গুরুজনে, সখীদলবলে
ভাসাইয়া বিদায়ের শোক-অশ্রুজলে।
ঘাটে আসি দেখে, সেথা আগেভাগে ছুটি
রাখাল বসিয়া আছে তরী-'পরে উঠি
নিশ্চিন্ত নীরবে। 'তুই হেথা কেন ওরে'
মা শুধালো; সে কহিল, 'যাইব সাগরে।'
'যাইবি সাগরে! আরে, ওরে দস্যু ছেলে,
নেমে আয়।' পুনরায় দৃঢ় চক্ষু মেলে
সে কহিল দুটি কথা, 'যাইব সাগরে।'
যত তার বাহু ধরি টানাটানি করে
রহিল সে তরণী আঁকড়ি। অবশেষে
ব্রাক্ষ্মণ করুণ স্নেহে কহিলেন হেসে,
'থাক্ থাক্, সঙ্গে যাক।' মা রাগিয়া বলে,
'চল্ তোরে দিয়ে আসি সাগরের জলে!'
যেমনি সে কথা গেল আপনার কানে
অমনি মায়ের বক্ষ অনুতাপবাণে
বিঁধিয়া কাঁদিয়া উঠে। মুদিয়া নয়ন
'নারায়ণ নারায়ণ' করিল স্মরণ।
পুত্রে নিল কোলে তুলি, তার সর্ব দেহে
করুণ কল্যাণহস্ত বুলাইল স্নেহে।
মৈত্র তারে ডাকি ধীরে চুপি চুপি কয়,
'ছি ছি ছি, এমন কথা বলিবার নয়।'
রাখাল যাইবে সাথে স্থির হল কথা -
অন্নদা লোকের মুখে শুনি সে বারতা
ছুটে আসি বলে, 'বাছা, কোথা যাবি ওরে!'
রাখাল কহিল হাসি, 'চলিনু সাগরে,
আবার ফিরিব মাসি!' পাগলের প্রায়
অন্নদা কহিল ডাকি, 'ঠাকুরমশায়,
বড়ো যে দুরন্ত ছেলে রাখাল আমার,
কে তাহারে সামালিবে! জন্ম হতে তার
মাসি ছেড়ে বেশিক্ষণ থাকে নি কোথাও।
কোথা এরে নিয়ে যাবে, ফিরে দিয়ে যাও।'
রাখাল কহিল, 'মাসি, যাইব সাগরে,
আবার ফিরিব আমি।' বিপ্র স্নেহভরে
কহিলেন, 'যতক্ষণ আমি আছি ভাই,
তোমার রাখাল লাগি কোন ভয় নাই।
এখন শীতের দিন, শান্ত নদীনদ,
অনেক যাত্রীর মেলা, পথের বিপদ
কিছু নাই - যাতায়াতে মাস-দুই কাল -
তোমারে ফিরায়ে দিব তোমার রাখাল।'
শুভক্ষণে দুর্গা স্মরি নৌকা দিল ছাড়ি।
দাঁড়ায়ে রহিল ঘাটে যত কুলনারী
অশ্রুচোখে। হেমন্তের প্রভাতশিশিরে
ছলছল করে গ্রাম চূর্ণীনদীতীরে।।
যাত্রীদল ফিরে আসে; সাঙ্গ হল মেলা,
তরণী তীরেতে বাঁধা অপরাহ্নবেলা
জোয়ারের আশে। কৌতুহল অবসান,
কাঁদিতেছে রাখালের গৃহগত প্রাণ
মাসির কোলের লাগি। জল শুধু জল
দেখে দেখে চিত্ত তার হয়েছে বিকল।
মসৃণ চিক্কণ কৃষ্ণ কুটিল নিষ্ঠুর,
লোলুপ লেলিহজিহ্ব সর্পসম ক্রূর
খল জল ছল-ভরা, তুলি লক্ষ ফণা
ফুঁসিছে গর্জিছে নিত্য করিছে কামনা
মৃত্তিকার শিশুদের, লালায়িত মুখ।
হে মাটি, হে স্নেহময়ী, অয়ি মৌনমূক,
অয়ি স্থির, অয়ি ধ্রূব, অয়ি পুরাতন,
সর্ব-উপদ্রবসহা আনন্দভবন
শ্যামলকোমলা, যেথা যে-কেহই থাকে
অদৃশ্য দু বাহু মেলি টানিছ তাহাকে
অহরহ, অয়ি মুগ্ধে, কী বিপুল টানে
দিগন্তবিস্তৃত তব শান্ত বক্ষ-পানে!
চঞ্চল বালক আসি প্রতি ক্ষণে ক্ষণে
অধীর উৎসুক কন্ঠে শুধায় ব্রাক্ষ্মণে,
'ঠাকুর, কখন আজি আসিবে জোয়ার?'
সহসা স্তিমিত জালে আবেগসঞ্চার
দুই কূল চেতাইল আশার সংবাদে।
ফিরিল তরীর মুখ, মৃদু আর্তনাদে
কাছিতে পড়িল টান, কলশব্দগীতে
সিন্ধুর বিজয়রথ পশিল নদীতে -
আসিল জোয়ার। মাঝি দেবতারে স্মরি
ত্বরিত উত্তর মুখে খুলে দিল তরী।
রাখাল শুধায় আসি ব্রাক্ষ্মণের কাছে,
'দেশে পঁহুছিতে আর কত দিন আছে?'
সূর্য অস্ত না যাইতে, ক্রোশ দুই ছেড়ে
উত্তর বায়ুর বেগে ক্রমে উঠে বেড়ে।
রূপনারানের মুখে পড়ি বালুচর
সংকীর্ণ নদীর পথে বাধিল সমর
জোয়ারের স্রোতে আর উত্তরসমীরে
উত্তাল উদ্দাম। 'তরণী ভিড়াও তীরে'
উচ্চকন্ঠে বারম্বার কহে যাত্রীদল।
কোথা তীর! চারি দিকে ক্ষিপ্তোন্মত্ত জল
আপনার রুদ্রনৃত্যে দেয় করতালি
লক্ষ লক্ষ হাতে। আকাশেরে দেয় গালি
ফেনিল আক্রোশে। এক দিকে যায় দেখা
অতিদূর তীরপ্রান্তে নীল বনরেখা -
অন্য দিকে লুব্ধ ক্ষুব্ধ হিংস্র বারিরাশি
প্রশান্ত সূর্যাস্ত-পানে উঠিছে উচ্ছ্বাসি
উদ্ধত বিদ্রোহভরে। নাহি মানে হাল,
ঘুরে টলমল তরী অশান্ত মাতাল
মূঢ়সম। তীব্র শীতপবনের সনে
মিশিয়া ত্রাসের হিম নরনারীগণে
কাঁপাইছে থরহরি। কেহ হতবাক্,
কেহ-বা ক্রন্দন করে ছাড়ি ঊর্ধ্বডাক,
ডাকি আয়োজনে। মৈত্র শুষ্ক পাংশুমুখে
চক্ষু মদি করে জপ। জননীর বুকে
রাখাল লুকায়ে মুখ কাঁপিছে নীরবে।
তখন বিপন্ন মাঝি ডাকি কহে সবে,
'বাবারে দিয়েছে ফাঁকি তোমাদের কেউ,
যা মেনেছে দেয় নাই, তাই এত ঢেউ -
অসময়ে এ তুফান। শুন এই বেলা,
করহ মানত রক্ষা, করিয়ো না খেলা
ক্রুদ্ধ দেবতার সনে।' যার যত ছিল
অর্থ বস্ত্র যাহা-কিছু জলে ফেলি দিল।
না করি বিচার। তবু, তখনি পলকে
তরীতে উঠিল জল দারুণ ঝলকে।
মাঝি কহে পুনর্বার, 'দেবতার ধন
কে যায় ফিরায়ে লয়ে, এই বেলা শোন্।'
ব্রাক্ষ্মণ সহসা উঠি কহিলা তখনি
মোক্ষদারে লক্ষ্য করি, 'এই সে রমণী,
দেবতারে সঁপি দিয়া আপনার ছেলে
চুরি করে নিয়ে যায়!' 'দাও তারে ফেলে'
একবাক্যে গর্জি উঠে তরাসে নিষ্ঠুর
যাত্রী সবে। কহে নারী, 'হে দাদাঠাকুর,
রক্ষা করো, রক্ষা করো!' দুই দৃঢ় করে
রাখালেরে প্রাণপণে বক্ষে চাপি ধরে।।
র্ভৎসিয়া গর্জিয়া উঠি কহিলা ব্রাক্ষ্মণ,
'আমি তোর রক্ষাকর্তা! রোষে নিশচেতন
মা হয়ে আপন পুত্র দিলি দেবতারে,
শেষ কালে আমি রক্ষা করিব তাহারে!
শোধ্ দেবতার ঋণ, সত্য ভঙ্গ ক'রে
এতগুলি প্রাণী তুই ডুবাবী সাগরে!'
মোক্ষদা কহিল, 'অতি মূর্খ নারী আমি,
কী বলেছি রোষবশে ওগো অন্তর্যামী,
সেই সত্য হল! সে যে মিথ্যা কতদূর
তখনি শুনে কি তুমি বোঝ নি ঠাকুর!
শুধু কি মুখের বাক্য শুনেছ দেবতা!
শোন নি কি জননীর অন্তরের কথা!'
বলিতে বলিতে যত মিলি মাঝি-দাঁড়ি
বল করি রাখালেরে নিল ছিঁড়ি কাড়ি
মার বক্ষ হতে। মৈত্র মুদি দুই আঁখি
ফিরায়ে রহিল মুখ কানে হাত ঢাকি,
দন্তে দন্ত চাপি বলে। কে তারে সহসা
মর্মে মর্মে আঘাতিল বিদ্যুতের কশা -
দংশিল বৃশ্চিকদংশ। 'মাসি! মাসি! মাসি!'
বিন্ধিল বহ্নির শলা রুদ্ধ কর্ণে আসি
নিরুপায় অনাথের অন্তিমের ডাক।
চিৎকারি উঠিল বিপ্র, 'রাখ্! রাখ্! রাখ্!'
চকিতে হেরিল চাহি মূর্ছি আছে পড়ে
মোক্ষদা চরণে তাঁর। মুহুর্তের তরে
ফুটন্ত তরঙ্গ-মাঝে মেলি আর্ত চোখ
'মাসি' বলি ফুকারিয়া মিলালো বালক
অনন্ততিমিরতলে। শুধু ক্ষীণ মুঠি,
বারেক ব্যাকুল বলে ঊর্ধ্ব-পানে উঠি
আকাশে আশ্রয় খুঁজি ডুবিল হতাশে।
'ফিরায়ে আনিব তোরে' -কহি ঊর্ধ্বশ্বাসে
ব্রাক্ষ্মণ মুহুর্ত-মাঝে ঝাপ দিল জলে।
আর উঠিল না! সূর্য গেল অস্তাচলে।।
Subscribe to:
Posts (Atom)